অনেক সময়ই আমরা যে প্রশ্নের সম্মুখিন হই তা হলো বন্ধ্যাত্ব কেন হয়? এটা অত্যান্ত গুরুত্বপুর্ন প্রশ্ন কেননা এর সাথে অনেকাংশে একটি দম্পতির জীবন এবং এক বা একাধিক পরিবার নিবির ভাবে জরিত। বন্ধ্যাত্বের কারন যানার সাথে সাথে বন্ধ্যাত্ব কি এবং এ নিয়ে বিস্তারিত ধারনা থাকাও আবশ্যক।
বন্ধ্যাত্ব মূলত কি? বন্ধ্যাত্ব কাকে বলে।
বন্ধ্যাত্ব (Infertility) হল একটি শারীরিক অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি (পুরুষ বা নারী) একটি নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে, সাধারণত এক বছর বা তার অধিক সময় ধরে নিয়মিত যৌন সম্পর্ক স্থাপন সত্ত্বেও সন্তান ধারণে অক্ষম হন। এটি নারী বা পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই হতে পারে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি দুজনের সম্মিলিত চিকিৎসা ও সহায়তার প্রয়োজন হয়।
বন্ধ্যাত্বকে সাধারণত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়ঃ
১. প্রাইমারি ইনফার্টিলিটি (Primary Infertility): কোন দম্পতি যখন প্রথম সন্তান লাভের আশা করে এবং বারংবার সহবাসের মাধ্যমে চেষ্টা করেও ব্যার্থ হন তখন তাকে প্রাইমারি বন্ধ্যাত্ব বলা হয়। এই সঙ্গা তাদের জন্য প্রজোয্য যারা আগে আগে কখনও সন্তান ধারণ করতে সক্ষম হয়নি। একেবারেই প্রথম।
২. সেকেন্ডারি ইনফার্টিলিটি (Secondary Infertility): যখন কোনও দম্পতি পূর্বে এক বা একাধিক সন্তানের জন্ম দিয়েছে, কিন্তু পরে সফল সহবাস এবং বহু চেষ্টাতেও আর পুনরায় সন্তান ধারণ করতে পারছে না।
বন্ধ্যাত্ব কেন হয়?
বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে শারীরিক, পরিবেশগত, মানসিক এবং হরমোনাল সমস্যা। পুরুষ বা নারীদের মধ্যে এটি আলাদা কারণে দেখা যেতে পারে। কখনো পুরুষ কখনো নারী বা উভয়েই বন্ধ্যাত্বের শিকার হতে পারেন। নিচে নারী ও পুরুষের বন্ধ্যাত্বের কিছু প্রধান কারণ আলোচনা করা হলো।
নারীদের মধ্যে বন্ধ্যাত্বের কারণঃ
১. ওভুলেশন সমস্যা (Ovulatory Disorders):
নারীদের মধ্যে ডিম্বাণু উৎপাদনের সমস্যা হলে, তা তাদের বন্ধ্যাত্বের একটা অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে। এর মধ্যে পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) অন্যতম একটি সমস্যা। এতে ডিম্বাশয়ের মধ্যে ছোট ছোট সিস্ট গঠন হয় এবং ওভুলেশন হতে পারে না। যার ফলে সহবাস করলেও গর্ভবতী হওয়া যায়না।
২. ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লকেজ (Blocked Fallopian Tubes):
ফ্যালোপিয়ান টিউব গুলি যদি ব্লক হয়ে যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু মিলিত হতে পারে না। মুলত এই টিউব দিয়েই ডিম্বানু শুক্রানু জরায়ুর বাচ্চা উৎপাদন থলিতে প্রবেশ করে। যার কারনে নারী স্বাভাবিক গর্ভধারণে অক্ষম হন।
৩. এন্ডোমেট্রিওসিস (Endometriosis):
নারীর গর্ভধারনে ক্ষেত্রে অন্যতম একটি সমস্যা হলো এন্ডোমেট্রিওসিস। এই রোগে জরায়ুর অভ্যন্তরীণ স্তর (এন্ডোমেট্রিয়াম) বেড়ে গিয়ে জরায়ুর বাইরের অংশে বিস্তার লাভ করে থাকে। এন্ডোমেট্রিওসিস অনেক সময় ডিম্বাণু বা শুক্রাণুর চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। এটি একজন নারীর বন্ধ্যাত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
৪. হরমোনের সমস্যাঃ
অনেক নারীর হরমোনজাতীয় নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য হলো, থাইরয়েডের সমস্যা, প্রোল্যাকটিন হরমোনের মাত্রা বাড়া বা কমা, বা অন্যান্য হরমোনের সমস্যা বন্ধ্যাত্বের কারণ হয়ে দাড়ায়।
৫. গর্ভধারণে বয়সের প্রভাবঃ
নারীর বয়স ৩০ বছর বয়সের পর প্রজনন ক্ষমতা ক্রমেই হৃাস পায়। বিশেষ করে ৩৫ বছরের পর নারীদের ডিম্বানু তুলনামুলক কমে যায়। ৪০ বছরের পর গর্ভধারণের সম্ভাবনা আরও কমে যায়, কারণ ডিম্বাণুর সংখ্যা ও গুণগত মান বহুগুনে কমে যায়।
৬. শারীরিক অবস্থাঃ
অতিরিক্ত ওজন, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, মানসিক চাপ, বা শারীরিক অসুস্থতা (যেমন ডায়াবেটিস) বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে।
পুরুষদের মধ্যে বন্ধ্যাত্বের কারণঃ
১. কম শুক্রাণু সংখ্যা (Low Sperm Count):
পুরুষদের মধ্যে শুক্রাণু সংখ্যা যদি অল্প হয়, তবে গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমে যায়। এটি একটি অন্যতম কারণ।
২. শুক্রাণুর গুণগত সমস্যা (Poor Sperm Quality):
শুক্রাণু যদি অক্ষম বা নিষ্ক্রিয় থাকে, অথবা তাদের গতি কম থাকে, তাহলে শুক্রাণু ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছাতে পারে না এবং গর্ভধারণ সম্ভব হয় না।
৩. এজিং (Aging):
পুরুষেরও বয়সের সাথে শুক্রাণুর গুণগত মান কমে যেতে পারে, যদিও নারীর মতো তাদের প্রজননক্ষমতা এতটা দ্রুত কমে না, তবে ৪০ বছরের পর শুক্রাণুর গুণগত মানের উপর প্রভাব পড়তে পারে।
৪. স্বাস্থ্যগত সমস্যা (Health Conditions):
কিছু শারীরিক সমস্যা যেমন ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, বা পুরুষত্বহীনতা (Erectile Dysfunction) শুক্রাণু উৎপাদন ও গুণগত মানকে প্রভাবিত করতে পারে।
৫. পরিবেশগত বা লাইফস্টাইলের সমস্যাঃ
অতিরিক্ত তাপ, রাসায়নিক পদার্থ, বা মাদকদ্রব্য (ধূমপান, মদ্যপান) শুক্রাণুর গুণগত মানে প্রভাব ফেলতে পারে। অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক চাপও বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করতে পারে।
কারা অধিক বন্ধ্যাত্ব ঝুঁকিতে রয়েছে?
১. যাদের বয়স তুলনামুলক বেশিঃ
নারীদের জন্য ৩০ বছর বয়সের পর এবং পুরুষদের জন্য ৪০ বছর বয়সের পর বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। নারীর ডিম্বাণুর গুণগত মান এবং পুরুষের শুক্রাণুর মান কমে যেতে থাকে।
২. যারা অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপনে অভ্যাস্তঃ
আপনি যদি জীবনযাত্রায় পরিবর্তন না আনতে পারেন তবে তা দীর্ঘমেয়াদে জীবনের বড় ক্ষতি করে ফেলবে। মাদকাশক্তি থাকলে এখনি দুর করে নিন। অ তিরিক্ত ধূমপান, মদ্যপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং মানসিক চাপ বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক চাপ প্রজনন ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
৩. অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক চাপে ভোগেন যারাঃ
দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ বা উদ্বেগের কারণে শরীরের হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে বন্ধ্যাত্বের ঝুকি বেড়ে যায়।
৪.যাদের ওজন তুলনামূলক বেশি এবং নানাবিধ শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেনঃ
অতিরিক্ত ওজন (অথবা খুব কম ওজন) প্রজনন স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সুস্থ থাকতে হলে ওজনের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বদাই শরীরের যত্ন নিতে হবে যার কোন বিকল্প নেই। এছাড়াও কিছু শারীরিক অসুস্থতা যেমন ডায়াবেটিস, থাইরয়েড সমস্যা, বা হরমোনাল অসঙ্গতি বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বাড়ায়।
৫. গর্ভপাতের পূর্ব ইতিহাসঃ
যারা অতীতে গর্ভপাত বা গর্ভধারণে সমস্যা সম্মুখীন হয়েছেন, তাদের মধ্যে ভবিষ্যতে বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে ভয়ের কিছু নেই। চেষ্টা করলে সহজেই একাধিকবার গর্ভপাত হওয়ার পরেও সুন্দর সুস্থ গর্ভধারন সম্ভব।
উপসংহারঃ
বন্ধ্যাত্ব একটি যদিও আর অন্য সব রোগের মতোই একটি রোগ, তবে এটি পরিবার এবং দম্পতির কাছে অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ। আশারর কথা হলো, আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্যে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা সম্ভব এবং অনেক ক্ষেত্রেই সফল ফলাফল পাওয়া যায়। বন্ধ্যাত্ব নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো এবং সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচলন অনেক দম্পতির জন্য সন্তানের স্বপ্ন পূরণের পথ খুলে দিতে পারে। আপনাদের বন্ধ্যাত্ব নিয়ে যে কোন পরামর্শ অথবা সেবার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ডাক্তার রফিকুর ইসলাম ভূইয়ার সাথে। বাংলাদেশে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাঃ রফিকুল ইসলাম ভূইয়া একজন অন্যতম অগ্রগামী চিকিৎসক এবং সফল গবেষক। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা ও নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করছেন এবং অসংখ্য দম্পতির জন্য সন্তান ধারণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছেন।