এন্ডোমেট্রিওসিসঃ চিকিসৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এন্ডোমেট্রিওসিস একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা বা ব্যাধি যা জরায়ুতে মারাত্বক রকম ক্ষতির কারন হয়ে দাড়ায়। নারীর জরায়ুতে যতগুলি জটিল সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে এন্ডোমেট্রিওসিস তার অন্যতম। মহিলাদের জরায়ুর সবচেয়ে ভেতরের গভীরতম স্তরের নাম এন্ডোমেট্রিয়াম। এই এন্ডোমেট্রিয়াম কোষ বা কলা যদি কোন কারনে জরায়ুর বাইরে বাসা বাঁধে বা কোন অংশ বেড়ে যায়, তখন তাকে বলে এন্ডোমেট্রিওসিস।
এন্ডোমেট্রিওসিস নারীদের এমন এক বেদনাদায়ক সমস্যা, যাকে সমুদ্রে ডুবে থাকা বরফখণ্ড বা ডুবো পাহাড়ের সাথেই তুলনা করা যায়। এর যতখানি প্রকাশিত, তার বেশিটাই থাকে লুক্কায়িত। হয়তো দেখা যায় না বা বেশির ভাগ সময় জানা জায়না কিন্তু ক্ষতিকর প্রভাব টের পাওয়া যায়।
নারীদেহের ডিম্বাশয়, বিভিন্ন লিগামেন্ট, অন্ত্র, সেপটাম, পেটের ভেতরের আবরণী পেরিটোনিয়াম, স্কার টিস্যু বা কাটা সেলাইয়ের ওপর জমতে পারে এই কোষ। জরায়ুর বাইরে অবস্থান থাকলেও মাসিক চক্রের সময় এই কোষগুলোর মধ্যেও প্রতিনিয়ত নানাবিধ পরিবর্তন ঘটে। মাসিকের সময় এর মধ্যে রক্তপাত হয় আবার অনেক সময় তীব্র থেকে ত্রীব্যতর ব্যথা অনুভুত হয়।
অনেক সময় বছরের পর বছর এই সমস্যার কোনো উপসর্গ না-ও থাকতে পারে। একবার ভাবুন তো আপনি এমন এক বিরল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন যে সম্পর্কে আপনার কোন ধারনাই নেই বা কোন ধরনের পরিবর্তন ও বুঝতে পারছেন না।
কিছু কিছু সময় আবার মাসিকের সময় তলপেটজুড়ে তীব্র ব্যথা, অনেক সময় সিজারের সেলাইয়ের দাগ বরাবর প্রচণ্ড ব্যথা হতে পারে। হয়তো বা আপনি ভেবে নিবেন এটা স্বাভাবিক বা অন্য কোন ধরনের কারন থাকতে পারে কিন্তু আপনি জানেন ও না যে আপনি এন্ডোমেট্রিওসিস নামক সমস্যায় জর্জরিত। হয়তো মাসিকের দু-তিন দিন আগে থেকে শুরু হতে পারে ব্যথা, যা মাসিকের সময় তীব্র আকার ধারণ করে। মাসিক শেষ হওয়ার পরও কয়েক দিন ব্যথা থেকে যায়। দেখা যায় যে, মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণও একটি লক্ষণ হতে পারে।
নারী দেহের অপরীহার্য চাহিদা সহবাস। অনেক ক্ষেত্রে এই এন্ডোমেট্রিওসিস এর কারনে সহবাসের সময় অসহ্য ব্যথা হতে পারে। চিকিৎসকদের ধারনা ও গবেষকদের অভিমত, শতকরা ৪০-৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে এর কারণে বন্ধ্যত্ব বা সন্তান ধারণে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো কোন ভাবে বাইরে থেকে দেখে বা কোনো পরীক্ষা করে এই রোগ শনাক্ত করা মুশকিল। আলট্রাসনোগ্রাফিতে সামান্য ধারণা পাওয়া যেতে পারে। একমাত্র ল্যাপারোস্কপির মাধ্যমে সঠিকভাবে সমস্যাটি নির্ণয় করা যায়। কিন্তু প্রধান সমস্যা হলো, কখনোই এই ধরনের লক্ষন বা উপসর্গ থাকলে ডাক্তারগন আপনাকে প্রথমেই ল্যাপারোস্কপির মতো বড় পরীক্ষা করতে উৎসাহ দিবেন না। তারা হয়তো আলট্রাসনোগ্রাফি বা এ ধরনের কিছু পরীক্ষা দিবেন প্রথমে যা থেকে এই এন্ডোমেট্রিওসিস রোগ নির্নয় বেশির ভাগই অসম্ভব। যতদিনে আপনি হয়তো ল্যাপারোস্কপির কাছে যাচ্ছেন তত দিনে অনেক দেরি ই হয়ে গেছে।
এন্ডোমেট্রিওসিস কেন হয়?
এন্ডোমেট্রিওসিস মুলত জরায়ুর রোগ। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার একেবারে সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো বিজ্ঞানিরা উদঘাটন করতে সমর্থ হননি তবে প্রত্যেক নারীরই মাসিকের রক্তের কিছু অংশ ডিম্বনালী দিয়ে তলপেটের বিভিন্ন অংশে পৌঁছাতে পারে। দেহের ম্যাক্রোফেজ নামক শ্বেত রক্তকণিকা এই অবাঞ্ছিত এন্ডোমেট্রিয়ামকে ধ্বংস করে থাকে। তবে কিছু মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার তুলনামুলক কম হওয়ার কারণে এই অবাঞ্ছিত এন্ডোমেট্রিয়ামকে ম্যাক্রোফেজ ধ্বংস করতে সমর্থ হয় না। যার ফলে এটি তলপেটের বিভিন্ন অংশে বাড়তে শুরু করে এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ ও যন্ত্রনাকর সমস্যার সৃষ্টি করে। কিছু জেনেটিক বা বংশগত কারণ ও এই রোগের জন্য অনেক ক্ষেত্রে দায়ী। এছাড়াও বিলম্বিত মেনোপজ, সংক্ষিপ্ত মাসিক চক্র (একটি সাধারণ চক্র 21-35 দিন হয়) অথবা লম্বা পিরিয়ডস (এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে থাকা) ইত্যাদি কারনে এন্ডোমেট্রিওসিস হতে পারে।
এন্ডোমেট্রিওসিস কাদের হয়? কারা এন্ডোমেট্রিওসিস ঝুঁকিতে আছেনঃ
- শতকরা ৬-১০ শতাংশ নারীদের এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
- মেয়েদের বয়স ৩০-৪৫ এর মধ্যে এই এন্ডোমেট্রিওসিস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অধিক।
- বন্ধ্যত্বে ভুগছে এমন নারী।
- যেসব নারী অনেক দেরিতে প্রথম সন্তান নিয়েছেন।
- এখন ও সন্তান গ্রহন করেননি এমন নারী।
- জেনেটিক বা এ রোগের পারিবারিক, বংশগত ইতিহাস রয়েছে এমন নারী।
এন্ডোমেট্রিওসিসের কারনে যেসব জটিলতা হতে পারে
- বন্ধ্যাত্বঃ জরায়ুতে বাসা বাধা এন্ডোমেট্রিওসিস একজন নারীর জীবনে বন্ধ্যাত্ব নামক অভিশাপ নিয়ে হাজির হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় অর্ধেকের বেশি বন্ধ্যাত্বের কারন নীরব ব্যাধি এন্ডোমেট্রিওসিস। এই সমস্যা বুঝতে অনেক সময় লাগে ততক্ষনে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়।
- ক্যান্সারঃ এন্ডোমেট্রিওসিস আক্রান্ত লোকদের জরায়ুতে ক্যান্সারের প্রবণতা তুলনামুলক বেশি থাকে। যদিও এন্ডোমেট্রিওসিস নানা ভাবে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, । কিছু মহিলা এন্ডোমেট্রিওসিস-সম্পর্কিত অ্যাডেনোকার্সিনোমা নামক বিরল ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। প্রথমে ধরা না পরলেও যাদের এন্ডোমেট্রিওসিসের ইতিহাস রয়েছে এমন মহিলাদের জীবনে পরবর্তীকালে এই ক্যান্সার বাসা বাধতে পারে।
- পেলভিক পেইনঃ পেলভিসের যেকোনো অঙ্গ থেকে সৃষ্ট ব্যথা হল পেলভিক পেইন। এই পেলভিসের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ থাকে, তার মধ্যে স্ত্রী জননাঙ্গ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও ইউরিনারি ব্লাডার, ইউরেটার, রেক্টাম ইত্যাদি থাকে।
পেলভিক পেইন এর সাধারণ কারণ হিসেবে সবচেয়ে সবচেয়ে অধিক দায়ী হল এন্ডোমেট্রিওসিস। পেলভিক পেইন জনিত এন্ডোমেট্রিওসিস একজন নারীকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দিতে পারে।
তবে আশার কথা হলো, পৃথিবীতে যত ধরনের সমস্যা রয়েছে সকল কিছুর ই সমাধান আছে। তাই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। যথাযথ চিকিৎসা এবংনির্দিষ্ট সময় পরপর ফলোআপ করলেই এ সমস্যা থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব।
পরবর্তিতে আরেকটি আর্টিকেলে এন্ডোমেট্রিওসিস এর প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত লেখা হবে। খুব সহজেই কিভাবে আপনি এই ঘাতক ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে পারেন তা তুলে ধরার চেষ্টা করবো। সে পর্যন্ত সুস্থ্য থাকুন। নিজের যত্ন নিন।