চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গা অনুসারে, ফ্যালোপিয়ান টিউব হল নারীদেহের প্রজননতন্ত্রের একটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপুর্ন অংশ। একজন নারীর ডিম্বাশয় থেকে জরায়ু পর্যন্ত প্রসারিত থাকে দুইটা টিউব। ডিম্বাশয় থেকে বের হয়ে নারীর ডিম্বাণু এই ফ্যালোপিয়ান টিউবের মধ্য দিয়েই জরায়ুতে প্রবেশ করে। ফ্যালোপিয়ান টিউব এর মধ্যেই শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর কাঙ্খিত নিষেক ঘটে এবং প্রাথমিক পর্যায়ের ভ্রূণ তৈরি হয়। এভাবে প্রায় পাঁচ দিন ফ্যালোপিয়ান টিউবে থাকার পর প্রাথমিক ভ্রূণ প্রবেশ করে জরায়ুতে। অর্থাৎ ভ্রূণের প্রাথমিক অবস্থান ও বৃদ্ধিতে ফ্যালোপিয়ান টিউব খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সন্তান জন্মদানে নারীদেহে ফ্যালোপিয়ান টিউব এর গুরুত্বঃ
স্বাভাবিক গর্ভধারনঃ
প্রতিটি নারীর দেহে দুটি ফ্যালোপিয়ান টিউব থাকে। এই একজোরা ফ্যালোপিয়ান টিউব টিউব দিয়েই ডিম্বানু নিষেকের পর জরায়ুতে প্রবেশ করে। অনেক সময় সামান্য কারনেও এই ফ্যালোপিয়ান টিউব টিউব ক্ষতিগ্রস্থ হলে ওই নারী সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়ে যায়। স্বাভাবিক সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে দুটি ফ্যালোপিয়ান টিউব সচল থাকা গুরুত্বপুর্ন। যদি কোন কারনে একটি ফ্যালোপিয়ান টিউব ক্ষতিগ্রস্থ হয় তবে নারীর সন্তান ধারনের সম্ভাবনা ৫০ শতাংশের নীচে নেমে যায়। আর অবশিষ্ট একটি ফ্যালোপিয়ান টিউব যদি কোন কারনে ব্লক বা অন্য কোন ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হয়ে যায় তবে তার স্বাভাবিক উপায়ে মা হওয়ার সম্ভাবনা শুন্যের কোঠায় নেমে আসে। অনেক সময় এমন রোগী আমাদের কাছে আছে যার স্বামী সম্পুর্ন সুস্থ্য। শুক্রানু ঠিক আছে। নারীকে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, তার ডিম্বানু স্বাভাবিক, পারিবারিক বন্ধ্যাত্বের হিস্ট্রি নেই এবং কোন সমস্যা ও ধরা পরছে না। তখন আমরা খেয়াল করি তার ফ্যালোপিয়ান টিউব এর অবস্থা। বেশির ভাগ সময় দেখা যায় যে, সেক্ষেত্রে ওই নারীর ফ্যালোপিয়ান টিউব কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বিধায় সে স্বাভাবিক গর্ভধারন করতে পারছে না। একজন নারীর স্বাভাবিক গর্ভধারনে শরীরের যে অঙ্গগুলি সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন তার মধ্যে সবচেয়ে অধিক গুরুত্ববহন করে সুস্থ্য ফ্যালোপিয়ান টিউব।
নারীর সুস্থতাঃ
কোন কারনে যদি একজন নারীর ফ্যালোপিয়ান টিউব ক্ষতিগ্রস্থ হয় তখন সেই নারী স্বাভাবিক সন্তান ধারনে যেমন সক্ষমতা হারায় ঠিক তেমনি তার শরীরে বিরল নানাবিধ সমস্যা দেখা যায়। বিরল ক্ষেত্রে এমন সমস্যা ও হয়ে থাকে যখন নারীর জরাযুর বাইরে গর্ভধারন হয়! এর অনুপাত খুবই নগন্য। মাত্র ১ শতাংশ বা এর ও কম। এটা এমন এক সমস্যা যার মাধ্যমে একজন নারীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে। আমরা জানি যে, যদি ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লক হয় তবে ডিম্বানু জরায়ুতে পৌছাতে পারেনা। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে একদল গবেষক এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। সাধারনত তলপেটে ব্যাথা ত্রীব্য থেকে ত্রীব্যতর হয়ে থাকে। ব্যাথানাশকে কোন সমাধান আছে না। অনেক সময় জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয়। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো গর্ভধারনের জন্য যে নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে সেখান অব্দি ডিম্বানু পৌছায়নি, তার মানে এমন জায়গাত তা অবস্থান করছে যেটা আসলে একটা নালি। ফলে নালি তার স্বাভাবিকতা হারায়। আশংকা জনক খবর হলো এমন অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসা না করালে বড় ক্ষতি হয়। টিউব ফেটে যেতে পারে। সমস্যা হলো আপনি বুঝতেও পারবেন না যে আপনি গর্ভবতী! একবার অনুমান করুন,তাহলে আপনি হয়তো চিকিৎসকের পরামর্শ ও নিবেন না। এবং যখন ডাক্তারের কাছে যাবেন ততদিনে অনেক সময়ই দেরি হয়ে যায়। ডাক্তারি ভাষায় এ সমস্যাকে বলা হয়ে থাকে এক্টোপিক প্রেগনেন্সি। নারীর ডিম্বানু নিষেকের পর ভ্রুন জরায়ুর বাইরে অন্য কোথায় থেকে গেলে বা বাড়তে থাকলে তাকে এক্টোপিক প্রেগনেন্সি বলে।
ফ্যালোপিয়ান টিউব এর কার্যকারিতা বিনষ্ট হওয়াঃ
ব্লক বা ব্লকেজ এর মাধ্যমে স্বাভাবিকতা নষ্ট হওয়াঃ
ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লকেজ হওয়ার সঠিক কারন অনেক সময়ই চিহ্নিত করা যায় না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগন এর জন্য নানাবিধ সংক্রমণকে অনেকাংশেই দায়ী মনে করেন। যেমন যৌন সংক্রমণ (STI), বিশেষ করে ক্ল্যামাইডিয়া এবং অন্ত্র বা এপেনডিক্স থেকে সংক্রমণ। অনেক সময় পেলভিক ইনফেকশন বা অন্য কোন ধরনের ইনফেকশন, টিবি এবং টিউব ক্লেজিংয়ের কারনে ফ্যালোপিয়ান টিউবে ব্লকেজ হতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, বেশিরভাগ নারীরই এই মারাত্মত ব্লকের কোন লক্ষণ থাকেনা। যদি আপনার এর আগে তলপেটে সংক্রমণ, শরীরের যে কোনও অংশে যক্ষ্মা, এক্টপিক প্রেগনেন্সি, এপেনডিক্স বা গাইনিকোলজিক্যাল সার্জারি, বা আপনি মাসিকের সময় বা যৌন সম্পর্কের সময় গুরুতর ব্যথা অনুভব করেন, তবে এসব ক্ষেতে ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লকের সম্ভাবনা রয়েছে।
ক্ষত তৈরি হওয়াঃ
আমাদের দেশে যক্ষ্মা খুবই সাধারণ একটি রোগ। এই রোগ অন্যান্য সংক্রামক রোগের মতো শরীরে যে কোন অঙ্গে নানাবিধ ক্ষত তৈরি করতে পারে। দেখা যায় যে এসব রোগ কিছুটা নীরবে নারীর দেহে অবস্থিত ফ্যালোপিয়ান টিউব কে আক্রমন করে ক্ষত তৈরী করছে। এন্ডোমেট্রাইটিস টিউবাল ব্লকেজের একটি সাধারণ কারণ। বর্তমানে মহিলা বন্ধ্যাত্বের 20-25% ক্ষেত্রে টিউবের সমস্যা নির্নয় করা হয়।
কোন অপারেশন বা অন্যান্য কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াঃ
কোন তলপেটের সার্জারি (ডিম্বাশয়, জরায়ু, এমনকি এপেনডিক্স) টিউবগুলিকে গতিগ্রস্থ করতে পারে। অনেক সময় অপারেশনের সময় এই ফ্যালোপিয়ান টিউব স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারাতে পারে। এর ফলে টিউব ডিম্বাশয় থেকে ডিম সংগ্রহ করতে পারে না। কখনও কখনও এই ধরনের অপারেশন জরায়ুর ফাইব্রইড টিউব সংকীর্ণ করে দিতে পারে। আগে এক্টপিক প্রেগনেন্সির ইতিহাস আছে এমন মহিলাদের ও ফ্যালোপিয়ান টিউব এর কার্যকারিতা বিনষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কিছু অস্বাভাবিকতা, একটি নারীর জন্মের সময় থেকেই টিউবগুলি দুর্বল বা অকার্যকর করে তুলতে পারে।
পরিশেষে এটা স্পষ্ট যে, একজন নারী সন্তান জন্মদিতে গেলে যেমন গর্ভধারন করতে হবে তেমনি স্বাভাবিক গর্ভধারনে ফ্যালোপিয়ান টিউব থাকা আবশ্যকীয়। কোন নারী যদি, মাসিকের সময়, যৌন সঙ্গমের সময় অথবা নানা সময় অকারনে তলপেতে ব্যাথা অনুভব করে তখন হাত গুটিয়ে বসে না থেকে নিকটস্থ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহন করা আবশ্যকীয় কেননা এসব ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লকের একেবারে প্রাথমিক লক্ষন। এসব সমস্যা পিরিয়ডের সময় ও হতে পারে বা অন্য সময় সুস্থ্য অবস্থায়ও সাদা স্রাবের প্রভাব হতে পারে যখন ব্যাথা অনুভুত হয়। চিকিৎসার মাধ্যমে অবশ্যই এই সর্বনাশা সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব তবে প্রয়োজন প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহন করা।